একটি হেরে যাওয়া জীবনের গল্প
একটা মানুষ কতটা হারতে পারে। চলার পথে যে কেউ পড়ে যেবে আবার উঠে দাড়াবে, এটাই নিয়ম বা নিয়তি। আর আমার জন্য শুধু হেরে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নেই। কিছুই করতে পারলাম না। অনেকেই বলে চলতে চলতে বড় ক্লান্ত। আমি হারতে হারতে আজ বড়ই ক্লান্ত। আর কিছু নেই আর হারাবার তাও হারিয়ে চলেছি। ভাল সন্তান, ভাল স্বামী, ভাল বাবা কিছুই হতে পারি নাই।
২০১১সালের ১৬ জুন আমার আব্বাকে হারালাম। সেই থেকে শুরু। তার আগে তো চলছিল, খুব বেশি ভাল না হলেও। আব্বা মারা যাবার আগে ঢাকায় পল্টনে একটা দোকানের অর্ধেক জায়গা ভাড়া নিয়ে আমার কাজ ছিল। সারা দিনে যা আসতো মোটামুটি ভালই। তখনকার সময়ও মাসের ৩০ দিন পর হিসাব করলে ২৫ থেকে ৩০ হাজার এর মতো আয় ছিল।
অধপতনের শুরুঃ ঢাকার পল্টনে কম্পিউটারের কাজ করতাম গ্রাফিক্স, কম্পোজ, ছবি প্রিন্ট, ইন্টারনেটের কিছু ইত্যাদি। আব্বাকে দাফন করে ঢাকাতে ফিরার কিছু দিন পর ঢাকায় ফিরলাম। দোকানে গিয়ে দেখি দোকানের নতুন একটা ছেলে কাজ করছে, নতুন কম্পিউটারে আমি যা করি সেই সব কিছু। আর আমার কম্পিউটার সামনে থেকে পিছনে সরিয়ে দেওয়া। রাগারাগির এক পর্যায়ে দোকান ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ দোকানে তখন ৫টা কাজ আসলে আমি ১/২টা পেতাম।
এমতাবস্থায় অর্থ সংকটে পড়তে শুরু করলাম। কি করবো কিছু উপায় না পেয়ে দোকান ছেড়ে দিয়ে অন্য জায়গাতেও চেষ্টা করলাম। চুক্তিতে কাজ শুরু করলাম। কিন্তু টিকে থাকা সম্ভব হলো না। কারণ সেখানে আয় কম। সারাদিনে যা আয় হতো তা দিয়ে আমার খাবারের বিল পরিশোধ করতে কষ্ট হতো। ঢাকাতে তখন আমার এমন কেউ ছিল না যে একটা কাজ যোগাড় করে দিবে। কোন পথ যখন পাচ্ছি না তখন ঢাকাকে বিদায় জানানো ছাড়া উপায় পেলাম না। তারউপরে আব্বা মারা যাবার পর আমার মা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। চলে আসলাম ঢাকা ছেড়ে।
২০১২ সালের জানুয়ারী মাসের ১ তারিখে ওডেক্সে একাউন্ট করলাম। বন্ধু মামুন সৃজন এর হাত ধরেই। মূলত ঐ সব দেখিয়ে দিয়েছিল। সামান্য কিছু হলেও গ্রাফিক্সের কাজ করতে জানা ছিলো। বলা হয় নাই, পূর্বের বেশ কয়েক বছর প্রিন্টিং প্রেসে গ্রাফিক্সের কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। ওডেক্সের কাজের সাথে একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে মোটামুটি নিজে চলার মতো কিছু আয় করতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু…………….!!! আবার থেমে যাওয়া। ২০১২ থেকে শুরু করে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত কাজ করতে পারলেও কোন অজানা করনে কাজ পাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তারপরও কিছু কিছু কাজ করেছি তাতে জীবন চালাতে ব্যার্থ। সর্বশেষ বুঝতে পারলাম পারলাম ওডেক্সে আমার একাউন্টটা অটো-হাইডে পড়ে গেছে। তারপর থেকেই অন্ধকারে পড়ে আছি। হাজার চেষ্টা করেও কিছু করতে পারিনি।
সংসারঃ ফেসবুকে প্রায় অধিকাংশ মানুষই দেখি কি সুন্দর স্ট্যাটাস দেয়। শুধু পড়ি আর দেখি। ভালবাসার মানুষের সাথে আছেন, এক সাথে ঘর করছেন, সুখেও আছেন, ভাললাগে দেখলে। সংসার বলতে যা বুঝি তার কিছুই করতে পারিনি। বললে হয়তো বলবেন ঘরের কথা পরের কাছে বলছি কেন? ২০০৫ সালে প্রেমের টানে ভালবাসার মেয়েটিকে বিয়ে করলাম। এখনো আমার সাথেই আছে ঝুলন্ত অবস্থায়। কারণ এই লম্বা সময়ে আমাদের সাথে আরো একটা প্রাণের যোগ হয়েছে। তার জন্যই ঝুলন্ত অবস্থায় আছি। শুধু মাত্র মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। এই বিষয়টা বন্ধ করি। কারণ এই বিষয়টা যত দূর লিখবো ঠিক ততদুর-ই বিষাক্ত।
এতোটুকু বলি বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশি সবার কাছ থেকে দূরে সরে আসতে আসতে আজ এতটাই অন্ধকারে চলে গেছি যে সেখানে কোন মানষিক রোগিও থাকতে পারবে না। যারা আমার লেখা পড়ছেন বলবেন কেন? ছেলে মানুষ কোথাও চলে গেলেই হয়। কিছু একটা করে তো খেতে পারবেন? সেটিও পারবো না।
আমার আব্বার মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সম্পতি বলতে গ্রামের আমাদের ভিটাবাড়ী ১০ শতাংশ আর মাঠে ১০ শতাংশ জমি। যা বিক্রি করলে এখন হয়তো সর্বমোট ৬ থেকে ৮ লক্ষ টাকা পাওয়া সম্ভব। দুই বোনকে তাদের অংশ সাথে মায়ের অংশ ভাগাভাগি করে দিলে আমার জন্য হয়তো ৩ থেকে সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা পাবার আশা আছে। এই টাকা দিয়ে কি করা যাবে চিন্তায় আছি।
আব্বু আমার কিছু লাগবে না। তুমি বাড়ীতে আস……… এখনি আস………
এইতো সেদিন জন্ম নিল স্বর্ণালী। ওর কান্নার শব্দ ভেসে আসার সাথে সাথে এক পশলা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল ক্লিনিকটির চারিপাশ। বাবা-মায়ের অনেক আদরের একমাত্র মেয়ে স্বর্ণালী। স্বর্ণালীর বয়স যখন এক বছর তার বাবা তাকে ছেড়ে বড় শহরে আছে কাজের জন্য। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের এক আদরের সন্তান স্বর্ণালী। সেই স্বর্ণালী এখন একটু বড় আর অনেক দুষ্টু। তিন বছর পার করেছে তার জীবনের, এখন চারের কাছাকাছি বয়স। সারা দিন কত প্রশ্ন, কত অযুহাত। কথা বলে শেখানো ময়না পাখির বুলির মতো। স্বর্ণালীর বাবা বড় শহরে থাকে। মাঝে মাঝে কথা হয় মোবাইলে। এইতো ঈদের আগে স্বর্ণালীর আবদার
স্বর্ণালী-আব্বু আমার জন্য একটা লাল গাড়ী, একটা সবুজ গাড়ী, একটা সাদা গাড়ী, ৩টা জামা, ৩টা জুতা আনতে হবে।
বাবা – তিনটা জুতাই লাগবে?
স্বর্ণালী- হা।
বাবা- তিনটা জুতা দিয়ে কি হবে?
স্বর্ণালী-তুমি বুঝবে না!! (ও পাশ থেকে তার মাকে বলছে, আম্মু দেখ না আব্বু পচাঁ আমার ৩টা জুতা লাগবে, বোঝে না।
বাবা- আচ্ছা ঠিক আছে, আর কি লাগবে?
স্বর্ণালী-আর ৩টা খেলনা।
(কিছু সময় একটু থেমে আছে)
বাবা- মামনি…………… হ্যালো……… স্বর্ণালী……… মামনি কি হলো বাবা কথা বল।
স্বর্ণালী- আব্বু আমার কিছু লাগবে না। আব্বু তুমি বাড়ীতে আস……… এখনি আস……… গাড়ীতে উঠ…………. উঠেছ গাড়ীতে………………আম্মু দেখ আব্বু আসবে না!!!
মুঠো ফোনের ওপাশ থেকে হঠাৎ করেই কান্নার আওয়াজ। আব্বু আসছে না…………….. আব্বু……….. আব্বু।
বাবা- মামনি আমি আসবো কেঁদনা……. মামনি……………. বাবা……….. আব্বু আমার।
স্বর্ণালী-আব্বু তুমি এখন–ই চলে আস।
বাবা- আসবো বাবা. এই একটু পরেই গাড়ীতে উঠবো!!
স্বর্ণালী-এখুনি।
বাবা- হা, বাবা এখন মোবাইল রাখি।
স্বর্ণালী- হা।
ফোন রেখে চোখ মুছেন স্বর্ণালীর বাবা। অপলকে তাকিয়ে থাকেন গত রাতের কেনা তার মেয়ের খেলনার দিকে। দু’চোখ বেয়ে তখন শুধু অশ্রুই পড়তে থাকে আর কানে বাজে মেয়ের সেই কথা- আব্বু আমার কিছু লাগবে না। ”আব্বু তুমি বাড়ীতে আস……… এখনি আস……… গাড়ীতে উঠ…………. উঠেছ গাড়ীতে” ?